বিরোধিতা করলেই মুখ বন্ধ করার নীতি; প্রতিবাদে সামিল দেশ-বিদেশের দুই হাজার শিক্ষাবিদ

সমালোচনা করলেই তার মুখে এঁটে দেয়া হবে কুলুপ, এটাই যেন গতি-প্রকৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতির। সেই ঘটনার পক্ষে বড় প্রমাণ, ২০১৮ সালে পশ্চিম মহারাষ্ট্রে ভীমা কোরেগাঁও সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে মানবাধিকার কর্মী এবং শিক্ষাবিদ মিলিয়ে ১২ জনেরও বেশি ব্যক্তির গ্রেফতার। এই ব্যক্তিদের গ্রেফতারের পিছনে অদ্ভুত যুক্তি দেওয়া হয়েছিল জাতীয় তদন্ত সংস্থার তরফে। মূলত এই সকল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সহিংস আন্দোলন এবং মাওবাদীদের সঙ্গে যোগসাজশের। পুলিশের চোখে ষড়যন্ত্রী হিসেবে নাম উঠে এসেছিল কবি, লেখক, অধ্যাপক, আইনজীবী, সমাজকর্মী সকলেরই। সেখানে যেমন নাম ছিল আট ৪৮ বছর বয়সী লেখক ও সমাজকর্মী অরুণ ফেরেরার, তেমনই চক্রান্তে জড়িত থাকায় অভিযোগ উঠেছিল ৭৮ বছর বয়সী কবি ও অধ্যাপক ভারভারা রাও কিংবা ৮৩ বছর বয়সী সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীর।

সেই সময় নজিরবিহীন এই ঘটনার নিন্দায় সরব হয়েছিলেন রামচন্দ্র গুহ, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, অরুন্ধতী রায় সহ অসংখ্য বিশিষ্ট মানুষ। দেশজুড়ে অলিখিত জরুরি অবস্থা চলছে বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাঁরা। মূলত শাসকদলের বিরুদ্ধে মুখ খোলার অভিযোগেই এইসব মানুষদের গ্রেফতার করা হল বলে অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তারপরেও দীর্ঘদিন ধরে মামলা বা তদন্ত চলার পরেও শিথিল হয়নি এই বিতর্ক। বরং আরও জোরালো হল সরকারের সমালোচনা করলেই সমালোচকদের হেনস্থা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। দাবি উঠল অন্যায় ভাবে জেলে পোরা হয়েছে যে সকল ব্যক্তিদের, অবিলম্বে তাঁদের মুক্তি ঘোষণার জন্য। দেশে-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রায় দু’হাজার শিক্ষাবিদের এই দাবির সমর্থনে তাতে স্বাক্ষর করায় আরও গুরুত্ব পেল এই ঘটনা।

শিক্ষাবিদদের আবেদন, সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহিতা নয়। তাই অমূলক দেশ বিরোধিতার অভিযোগে সমালোচকদের ‘টার্গেট’ করা বন্ধ করুক কেন্দ্র। আবেদনকারীরা জানিয়েছেন, এই মামলায় এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে যাঁদের মধ্যে কেউ কখনও ভীমা কোরেগাঁওতে পা অবধি রাখেননি। তাই নিতান্ত অন্যায় ভাবেই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও কর্মীদের মুখ বন্ধ করার জন্যই এই মিথ্যা মামলা ও তদন্তের জালে তাদের ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ আবেদনকারীদের।

শিক্ষাবিদদের স্বাক্ষর প্রচারের মাধ্যমে একটি বিষয় তীব্রভাবেই সামনে উঠে এসেছে। সেটি হল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র বিরোধীতা দমন নীতি। এর ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্ত চিন্তা-ভাবনার ঐতিহ্য রীতিমতো বিপন্নতার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদেরা।

আরও পড়ুন
আদালতের সমালোচনা বাকস্বাধীনতারই অঙ্গ, গণতন্ত্রের সে-কথাই মনে করিয়ে দিলেন প্রশান্তভূষণ?

স্বাক্ষরকারীরা জানিয়েছেন, গ্রেফতার হওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদের বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে তাতে তাঁদের জামিন পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। বেআইনি কার্যক্রম এবং দেশদ্রোহ আইন অবশ্যই ছোটখাটো কোনও বিষয় নয়। এই প্রসঙ্গে সমাজকর্মী গৌতম নওলাখার একটি বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ২০১৮ সালে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “অপরাধ করি অথবা না করি, শাস্তি পাওয়া তো হয়েই গেল! কারণ, নির্দোষ প্রমান না হওয়া অবধি অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবেই থেকে যেতে হবে।” সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি ভীষণ রকম ক্ষোভ এবং হতাশা না জন্মালে যে এমন মন্তব্য করা যায় না, তা নিয়ে অবশ্যই সন্দেহের অবকাশ নেই।

বস্তুত এই সকল ব্যক্তিকে অভিযুক্ত প্রমাণ করে শাস্তি দেওয়ার বেশির ভাগ মামলাই প্রাথমিকভাবে খারিজ হয়ে গিয়েছিল আদালতে। তারপরেও কোনও কোনও বিশিষ্ট জনকে জোর করে আটকে রাখায় তা বেআইনি এবং আদালত অবমাননারই সামিল বলে অভিযোগ করেছিলেন সেই সকল ব্যক্তিদের আইনজীবীরা।

আরও পড়ুন
‘সবহি কা খুন হ্যায় সামিল ইয়াহাঁ কি মিট্টি মে,’ প্রতিবাদের ভাষা যুগিয়েছিলেন রাহাত ইন্দোরি

২০১৮ সালে দলিতদের একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা তৈরি হয় গোটা মহারাষ্ট্র জুড়ে। ভাদু বুদরুক গ্রামে সংঘর্ষ বাঁধে দলিত এবং মারাঠাদের মধ্যে। একজন মারা যান সংঘর্ষে। জখমও হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন গুজরাটের দলিত নেতা জিগ্নেশ মেবানি, ছাত্রনেতা উমর খালিদ, রোহিত ভেমুলার মা রাধিকা ভেমুলা সহ একাধিক বিশিষ্ট মানুষেরা। এর প্রেক্ষিতে রাজ্যজুড়ে বনধ্ ডাকে দলিত সম্প্রদায়। তার প্রেক্ষিতেই নিয়ন্ত্রণ হারায় পরিস্থিতি। ভয়াবহ হিংসা শুরু হয় মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়। প্রসঙ্গত সেই সময় মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবীশ।

কিন্তু কেন এই সংঘর্ষ? ইতিহাস বলছে ১৮০০ সালে কোরেগাঁও যুদ্ধে মারাঠারা লড়াই করেও পরাজিত হয়েছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধে ইংরেজদের হয়ে লড়াই করেছিলেন দলিত সম্প্রদায়। এবার দক্ষিণপন্থী নেতাদের যুক্তি, এই জয়কে উদযাপন করা মানে প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদেরই সম্মান জানানো। উল্টোদিকের যুক্তি বলছে, ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, মারাঠা জাতিদের প্রবল অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়েই ছিলেন দলিতরা। তাই সেই সময় মারাঠা জাতিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার একটি সুযোগ পেয়েই সেই বিক্ষোভ পরিণত হয়েছিল বিস্ফোরণে।

আরও পড়ুন
প্রয়াত সমাজকর্মী এবং লেখিকা ইলিনা সেন, থেমে গেল বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠ

কিন্তু প্রাচীনকালে ঘটে যাওয়া এই যুদ্ধের ক্ষত যে মিলিয়ে যায়নি এখনও, তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। তাই একটু ভেবে দেখা কি উচিত নয়, একই অঞ্চলের বাসিন্দা হয়েও কেন 'দেশদ্রোহী'দের মতো মারাঠাদের হারাতে বিদেশিদের হাত ধরল দলিত মানুষেরা? কেন এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ? বর্তমান সময়ের দিকে তাকালে কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে কি? ইতিহাসের চাকা কিন্তু ঘোরে বলেই শোনা যায়!

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

আরও পড়ুন
অস্থির সময়ের প্রতিবাদ সাহিত্যেই, নতুন ইস্তাহার প্রকাশ বাংলার সাহিত্যিকদের

Powered by Froala Editor

More From Author See More