মালদা জেলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম গম্ভীরা। শৈব লোকাচারকেন্দ্রিক গম্ভীরায় চামুণ্ডা মুখা বা মুখোশের বিশেষ ভূমিকা আছে। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে হরিদাস পালিত তাঁর 'আদ্যের গম্ভীরা' নামের কালজয়ী গ্রন্থে পুরাতন মালদার চৈত্র সংক্রান্তির গম্ভীরা উৎসবের পূর্বে বাচামারির চামুণ্ডা (Devi Chamunda) পূজার উল্লেখ করেছিলেন। শতাব্দী প্রাচীন সেই পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পুরাতন মালদার (Malda) ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। ১৮ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ ডে-র প্রাক্কালে এই লোকউৎসবে জনসমাগম ছিল দেখার মতো।
নানা সময় দেশ-বিদেশের গবেষকরা নানাভাবে দেখিয়েছেন, শৈবসংস্কৃতির সঙ্গে গম্ভীরার শিল্পগত সংযোগের মাত্রাগুলি সব সময় একরকমের ছিল না। ২০১৯-এ লকডাউনের সামান্য আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রস্তাবিত আলোচনাচক্রে দুজন গবেষকের একটি যৌথ গবেষণাপত্র গৃহীত হয়।তাঁরা দেখিয়েছিলেন, গম্ভীরার এই দ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে 'রিচ্যুয়াল' বনাম 'পারফরম্যান্স'এর দ্বন্দ্ব।তাদের সেই প্রস্তাবিত গবেষণাপত্রের শিরোনামটিও ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ— “গম্ভীরা:পারফরমেন্স? রিচ্যুয়াল? অর ‘রেস এগেইনস্ট টাইম’?" মালদার হবিবপুর, বামনগোলা, পাকুয়াহাট বা নালাগোলা অঞ্চলের অন্তত ৫/৬টি গম্ভীরা মন্দিরে এখনো যেভাবে শতাব্দীপ্রাচীন রীতি মেনে গম্ভীরা পূজা ও উৎসব হয়, তার সঙ্গে কয়েক কিলোমিটার দূরে ইংরেজবাজার কেন্দ্রিক মালদা শহরে অনুষ্ঠিত গম্ভীরা গানের কোনো মিল নেই। কবি শঙ্খ ঘোষকে ধার করে বলা যায়—এক গম্ভীরার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেকগুলো গম্ভীরা। আর এই দ্বন্দ্বটা একেবারে প্রথম থেকেই আছে।
স্থানীয় লোকবিশ্বাসে এই পূজা বাচামারি জোড়াকালীর পূজা নামে পরিচিত। প্রতি বছর নীল ষষ্ঠীর আগের দিন এই পূজা হয়। দোসরা বৈশাখ সন্ধ্যাবেলায় মশাননাচের মাধ্যমে গম্ভীরা উৎসবের সূত্রপাত। সারা রাত ধরে সারস নাচ, টাপা নাচ, বুড়াবুড়ি নাচ পেরিয়ে তেসরা বৈশাখ সকালবেলা চামুণ্ডা আর বুড়িকালীর নাচ হয়ে দুপক্ষের মিলন ঘটিয়ে উৎসবের সমাপ্তি। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, শৈব সংস্কৃতিমূলক গম্ভীরা উৎসবের শুরুতে চামুণ্ডা এবং কালী গৌড়বঙ্গের দুই প্রাচীন শক্তি দেবীকে একত্রে স্মরণ করার সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব এই একটিই। ফলে এর প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্য নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড়ো অংশ চাইছেন, হেরিটেজের মর্যাদা পাক এই পুজো।
পুরাতন মালদার প্রাচীন বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব সুদীপ কুমার চক্রবর্তী স্মৃতি হাতড়ে বলেন, "এই পূজায় চামুণ্ডা এবং বুড়ি কালী নাচ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে চামুণ্ডা নাচ শুরু হয়।নাচ শেষ হবার পর চামুণ্ডার মুখোশ বুড়ি কালীর কাছে যায়। সঙ্গে ঢাক ও পাড়ার লোক থাকে। নাচতে নাচতে বাচামারি নিমতলিতে আসে। সেখানে আড়াই পাক নাচ। বুড়িকালীর মন্দিরে চামুণ্ডার মুখোশ কালীর কাছে রাখা হয়। এবার বুড়িকালীর মুখোশ নিয়ে নাচ শুরু হয়। এই নাচের সময় পায়রা ও লুট দেওয়া হয় তারপর চামুণ্ডা নাচ। চামুণ্ডাও আড়াই পাক ঘোরে। মুখোশ খুলে দুখানা মুখোশ একসঙ্গে বাচামারির নিমতলির শিব মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। নিমতলিতে বুড়িকালীর নাচ। কূলবধূরা পরস্পরকে সিঁদুর দেয়। নাচ শেষ হওয়ার পর পূর্ববর্তী স্থানে মুখোশ নিয়ে যাওয়া হয়। বছরে এই একবারই দুই বোনের মিলন ঘটে। নয়তো দুই মন্দিরেই আসন থেকে মুখোশ পড়ে যায়।"
কিছুদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অফ কালচার এন্ড রেকর্ডস এর প্রাক্তন গবেষক ড. ইমন ভট্টাচার্য ব্যক্তিগত স্তরে পুরনো আত্মজীবনীমূলক লেখা ডিজিটাইজড করতে গিয়ে পুরাতন মালদা দেবদেউল প্রকাশন সমিতি থেকে প্রকাশিত প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অধুনাদুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ হাতে পান। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে, বাচামারির প্রাচীন সিংহবর্মা পরিবারের বধূ শ্রীমতী স্নেহলতা সিংহবর্মা কর্তৃক লিখিত 'বাচামারীর জোড়াকালী' শীর্ষক প্রবন্ধে এই পূজার স্পষ্ট উল্লেখ পেয়েছেন—"...স্থানীয় লোকেদের ধারণায় পূজা প্রায় দুইশত বছরের প্রাচীন। পূজা বারোয়ারী। রাখাল ভট্টাচার্য বাচামারী স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। তিনি পৌরোহিত্য করিতেন। পরবর্তীকালে খোকন পান্ডে, সুরেশ পান্ডে, ভুক্কু ঠাকুর, কাঙ্গালী পান্ডে, উপেন পান্ডে পুজা করিতেন বলে জানা যায়।" এই লেখায় তিনি আরো বলছেন—"পূজা সাধারণত একটি ঢাকেই হইয়া থাকে। রাত্রি বারোটার পর পূজা আরম্ভ হয়। সারারাত চলে। কাঠের পাঠাতনের উপর মূর্তি উঠে। লম্বায় দুই ফুট এবং প্রস্থে আড়াই ফুট। দেবীর মাথার উপরে কোন আচ্ছাদন নাই। পূজার সময় সামিয়ানা খাটানো হয় মাত্র।" এই পারিবারিক স্মৃতিমূলক নাতিদীর্ঘ রচনা থেকে গম্ভীরা ও শক্তিপূজা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসতে পারে—এমনই অনুমান ওয়াকিবহাল মহলের।
পুরাতন মালদার গৌড় মহাবিদ্যালয়ের ইংরাজি বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক ড. নীলোৎপল সিংহবর্মা এই পারিবারিক স্মৃতিচারণ মূলক রচনাটি নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী: "স্নেহলতা সিংহবর্মা সম্পর্কে আমার পিতামহী ছিলেন। তিরিশ থেকে চল্লিশের দশকে তিনি আমাদের পরিবারের বধূ হয়ে আসেন বলে অনুমান। তিনি এমন একটি প্রামাণ্য লেখা লিখেছেন এটা আমাদের জানা ছিল না। তবে পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে এই পূজার প্রাচীনতায় আমরা বিশ্বাসী। বাচামারির বহু মানুষ যারা অনেক সময় দুর্গা পুজোতেও বাড়ি আসতে পারেন না, তারা এই চামুণ্ডা পূজা উপলক্ষে বাড়ি আসেন।" পুরাতন মালদা পৌরসভার ঐ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শত্রুঘ্ন সিংহবর্মা বলেন, "ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন পুজোয় প্রতিবছর বিপুল জনসমাগম হয়। পূজার পরে গম্ভীরা উৎসব ও মেলা ও সকলের উদ্যোগে সুষ্ঠুভাবে পালিত হয়। স্থানীয় মানুষেরা চান এই দুশো বছরের প্রাচীন পূজা ও উৎসব হেরিটেজের মর্যাদা পাক।"
কৃতবিদ্য সমাজতাত্ত্বিক বিনয় কুমার সরকার ১৯১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর 'ফোক এলিমেন্টস ইন হিন্দু কালচার' শীর্ষক প্রামাণ্য গ্রন্থে গম্ভীরার শৈব প্রভাবের পিছনে আদি মাতৃকাশক্তি চামুণ্ডার উল্লেখ করেছিলেন। স্মরণীয়,এই বরেণ্য বাঙালি মালদা জেলার ভূমিপুত্র ছিলেন।হেরিটেজ ঘোষণার লালফিতের ফাঁস খুলবে কি খুলবে না—তার উত্তর সময় দেবে; কিন্তু এই চামুণ্ডাপূজায় এখনো আবহমান বর্তমানের হাতে হাত রাখে।
ছবি ঋণ: লেখক ও কল্লোল মজুমদার
Powered by Froala Editor