শহর কলকাতা জুড়ে আজ অট্টালিকার সমাহার। তারই মাঝে মাঝে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের টুকরো। এই কংক্রিটের দৈত্য অবশ্য একা এই শহরকে নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা বিশ্বকে গিলে নিচ্ছে। এরই মধ্যেই বেশ কিছু জিনিস বদলায়নি। একইভাবে আধুনিকতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরুন, দমকল। শুধু আগুন নেভানোই দমকলের সর্বক্ষণের কাজ নয়। কেউ ব্রিজের মাথায় উঠে গেলে, বা অন্যান্য বিপর্যয়ও এগিয়ে আসেন এঁরা। যত কঠিন অগ্নিকাণ্ডই হোক না কেন, শহরবাসীর ভরসার নম্বর ‘১০১’।
আলোচনা যখন শুরুই হল, একটু পিছনের পাতায় নজর দেওয়া যাক। পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ব্রিটিশরাও কর্তৃত্ব নিয়ে বসেছে গোটা ভারতে। তখনও তাদের রাজধানী কলকাতা। সমস্ত ব্যবস্থা ঢেলে সাজাচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার। সেই সূত্রেই ১৮২০ সালে প্রথমবার কলকাতায় ফায়ার সার্ভিস শুরু করা হল। তবে সেই ব্যবস্থা একটু ‘সেকেলে’ ছিল। প্রতহম প্রথম দুজন ইউরোপিয়ান কনস্টেবল এবং ২৩৪ জন খালাসি ও ভিস্তিওয়ালা ছিল। কোনো গাড়ি ছিল না। ১৮৭১ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের অধীনে মাত্র পাঁচটি ফায়ার ইঞ্জিন তৈরি করা হয়; যার তিনটি ছিল ঘোড়ায় টানা গাড়ি। আর বাকি দুটি মানুষই টেনে টেনে নিয়ে যেত। বাস্তবিকই, তখন এত উঁচু বাড়ি ছিল না। সবে নতুন করে সবকিছু তৈরি হচ্ছে শহরে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা খুবই কম হত। তাই, গাড়িও ছিল কম।
এতক্ষণ তো আসল নামটাই ব্যবহার করা হয়নি। ‘দমকল’— সেই আদ্যিকাল থেকে বাঙালির কাছে অত্যন্ত পরিচিত এই নাম। কিন্তু দমকল নাম কেন? এই কথাটা জানতে গেলে এখনকার কলকাতার দুটো জায়গায় যেতে হবে। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার মোড়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে একটু নজর করলেই দেখা যাবে পুরনো জংধরা একটা লোহার বাক্স। গড়নটা লম্বাটে। এককালে নিশ্চয়ই কিছু ছিল, কিন্তু এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। কিন্তু কী এমন ছিল? সেটা জানতে গেলে একবার সাহস করে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ঢুকতে হবে। সেখানেই রয়েছে আসল জিনিসটা। লাল রঙের লম্বা, লোহার বাক্স। এটাই হল ‘দমকল’।
একটু খোলসা করে বলা দরকার। তখন তো টেলিফোনেরও চল ছিল না। মোবাইল সায়েন্স ফিকশনে আসবে হয়তো। কাজেই আজ যত সহজে খবর পাঠানো যায়, তখন তো এত সহজ ছিল না। আর আগুন লাগলে তো খবরটা তাড়াতাড়ি পৌঁছনো দরকার। কোথাও আগুন লাগলে, কেউ ছুটে গিয়ে খবর দিয়ে আসত ফায়ার সার্ভিস অফিসে। যতক্ষণে আসত, ততক্ষণে অধিকাংশই শেষ! কিন্তু এরকম করলে তো হবে না। তখন একটি উপায় বার করলেন ক্যাপ্টেন বার্নার্ড অ্যান্সন ওয়েস্টব্রুক। ১৯১০ সালে শহরের প্রতিটা মোড়ে বসিয়ে দিলেন লম্বা লম্বা লাল লোহার পিলার। যার সামনের দিক একটি কাচ দিয়ে ঢাকা থাকত। ভেতরে থাকত একটি হাতল। এই পুরো সিস্টেমটার সঙ্গে সংযোগ থাকত নিকটবর্তী অফিসের। আগুন লাগলে, কেউ ওই কাচ ভেঙে হাতল ঘোরাত, বা দম দিত। যার ফলে সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছে যেত অফিসে। সেখান থেকে কর্মীরা তাড়াতাড়ি জায়গা বুঝে চলে যেতেন অকুস্থলে। অনেকটা সুবিধা হয়ে গেল এর জন্য। এই যে ‘দম’ দিয়ে ডাকা, এর থেকেই কলকাতা তথা বাংলার ফায়ার সার্ভিসের ডাকনাম হয়ে গেল ‘দমকল’। শুধু কলকাতাতেই ১৫০-এরও বেশি এই লোহার কল বসানো হয়।
১৮৭১ সালেই পাঁচটি জায়গায় দমকলের অফিস তৈরি করা হয়। লালবাজার তো আছেই, সঙ্গে টালা, পামার’স ব্রিজ, ভবানীপুর, ওয়াটগঞ্জ। ১৮৯৩ সালে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে দমকলের দায়িত্ব চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কয়েকটা দমকল অফিস নষ্ট হয়ে যায়। পরে শুধু দুটি অফিসই টিকে থাকে— কলকাতা ফায়ার ব্রিগেড এবং দার্জিলিং ব্রিগেড। পরে আবার নতুন করে তৈরি হয়। এইখানে একটা ছোট্ট পুনশ্চ জুড়ে দেওয়াই যায়। পৃথিবীর সমস্ত ফায়ার সার্ভিসের দিকে তাকালে উজ্জ্বল লাল রংটাই নজরে আসবে। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কেন? প্রথমত, এমারজেন্সি সার্ভিসের জন্য। লাল রংটা তারই প্রতীক। এছাড়া এরকমও বলা হয়, আগে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা এই ফায়ার সার্ভিসের কাজ করত। লাল সবচেয়ে সস্তার রং ও বিপদের প্রতীক বলে এটিই ব্যবহার করা হত। পরে সেটাই রীতি হয়ে যায়।
আজ দমকল বাহিনী আরও বিস্তৃত হয়েছে। তার অফিসের সংখ্যা বেড়েছে আগের থেকে। কর্মীও বেড়েছে, ঘোড়ায় টানা গাড়ির বদলে এসেছে বড়ো গাড়ি। তাও অনেকের মতে, দমকলের ব্যবস্থাটা সেই মান্ধাতার আমলেই পড়ে রয়েছে। অনেক সময় খবর দেরিতে পৌঁছয়; পৌঁছলেও আসতে সময় লাগে। বেশ কিছু জায়গায় তৎপরতার অভাব দেখা যায়। তা সত্ত্বেও দিনের শেষে আমাদের ভরসা সেই চিরন্তন সাইরেনের আওয়াজ। আগুনের হাত থেকে রক্ষা করতেই তো তাঁদের সারাক্ষণ কাজ করে যাওয়া। ত্রুটি আছে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গার তুলনা করলে এখনও অত আধুনিক হয়নি আমাদের দমকল। তাও, চেষ্টা তো থাকেই। দমকল কর্মীরাও সেই চেষ্টাটুকুই করে যান। ঠিক-ভুলের মাঝখানে বিপদের দিনে আমাদের হাত ধরার নির্ভরযোগ্য বন্ধু হয়ে…
Powered by Froala Editor