২ টাকায় তেলেভাজা বিক্রি করেই মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন বেলঘরিয়ার দোকানি

ধরুন, হাঁটতে বেরিয়েছেন সন্ধেবেলায়। বেলঘরিয়ার দেশপ্রিয়নগরে, শ্রীপল্লী মাঠের গা ঘেঁষে এগোচ্ছেন আপনি। আলো-আঁধারি রাস্তা, সাইকেলের বেল হঠাৎ ভেঙে দিল আপনার ঘোর। শ্রীপল্লী ক্লাবের সামনেই, দেখতে পেলেন ছোট্ট একটা তেলেভাজার দোকান। আপনার বাঙালি জিভ যদি বর্ষার সন্ধ্যায় দুটো তেলেভাজা খেতেই চায়, মানা করবেন না। দর করতে গিয়ে, দোকানির কথা শুনে চমকে উঠলেন আপনি। এমনও হয় আজকের দিনে! যে-কোনো তেলেভাজার দাম মাত্র দু’টাকা! ধুর! সম্ভব নাকি?

হ্যাঁ, এমন আপাত-অসম্ভব ব্যাপারকেই সম্ভব করে চলেছেন বিক্রেতা তাপস সাহা। ডাকনাম উত্তম। এলাকার লোকজন ‘উত্তমের চপের দোকান’ হিসেবেই চেনে। শ্রীপল্লী ক্লাবঘরের গা ঘেঁষে, ছোট্ট দোকান তাপসবাবুর। গত তেইশ বছর ধরে চালাচ্ছেন এই দোকান। সোম থেকে শনি বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত নটার মধ্যে হাজির হলেই আপনি পেয়ে যাবেন আলুর চপ, লোটে মাছের চপ, সয়াবিনের চপ আর ভেজিটেবল চপ। কখনও কখনও পেঁয়াজি আর ডিমের চপ। ঘুরিয়েফিরিয়ে এই ছ’টি পদ নিয়েই তাপসবাবুর সাজানো দোকান।

‘এত কম দামে বিক্রি করেন কেন? আশেপাশের কোথাওই তো চার-পাঁচ টাকার কমে নেই। আপনি যদি দু’টাকা থেকে বাড়িয়ে তিনটাকাও দাম রাখেন, খদ্দেরের অভাব হবে না তো!’ জবাব দিতে গিয়ে হাসেন বছর তিপ্পান্ন-র তাপসবাবু। প্রথমে দাম ছিল মাত্র ১ টাকা। এমনকি, ১ টাকায় পাঁঠার মাংসের ঘুগনিও বিক্রি করতেন তিনি। বছর নয়েক আগে, বাধ্য হয়ে দাম বাড়ান তাপসবাবু। সেই থেকে দু’টাকা দাম। কোনোদিনই তেলেভাজার মধ্যে ভেদাভেদ আনেননি তিনি। যা যা আছে, সব দু’টাকা। তার ওপর, প্রায়ই একটি-দুটি চপ বিনামূল্যে খদ্দেরকে দিয়ে দেন তিনি। টাকা দিতে চাইলেও নেন না। তাপসবাবুর কথায়, ‘যতদিন পারব দু’টাকাতেই বিক্রি করে যাব। দাম বাড়াব না। আমার বেশি লাভের দরকার নেই তো! দু’বেলা ডালভাত জুটে গেলেই হল।’

এত কম দামে বিক্রি করলে লাভ থাকে বিশেষ? তাপসবাবু জানালেন, দিনে তিন-চারশো টাকা লাভ তো হয়ই! কম দামের জন্য, স্থানীয় খদ্দেরের অভাব হয়নি কোনোদিনই। তেলেভাজার দোকান থেকেই তাঁর বেশিরভাগ আয় ও সঞ্চয়। সেই সঞ্চয় থেকেই একমাত্র মেয়েকে পড়াচ্ছেন বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ‘এত খরচ, সামলাতে পারবেন?’ তাপসবাবুর উত্তর, ‘আপনাদের ভালোবাসা থাকলে সবই হবে।’

তাঁর স্ত্রী-ও দু-বেলা বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কোচিং ক্লাস চালান। গরিব ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ বেতন দিতে পারলেও, বেশিরভাগই পারে না। তা নিয়ে খেদ নেই দুজনের। এমএসসি করেও চাকরি পাননি তাপসবাবুর স্ত্রী। এখন তাঁদের স্বপ্ন মেয়েকে নিয়েই।

এভাবেই জীবনযুদ্ধ চলছে, চলবে। বেশি আয়ের সম্ভাবনা সত্ত্বেও নিজেকে যেভাবে শাসনে রাখেন তাপসবাবু, তা কি শুধু অভ্যাস? না কোনো ‘বোধ’ কাজ করে? কে জানে!