ইট, পাথর, কংক্রিটের চাঁই ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। তবু ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বহুতল। ভেতরে আগুন জ্বলছে তার। কুণ্ডলি পাকিয়ে আকাশ ছুঁচ্ছে ধোঁয়া। আর এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই বসে কেঁদে চলেছেন রক্তাক্ত এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর ছোট্ট সন্তানকে আর কোনোদিনও যে ফিরে পাবেন না তিনি। আজ উৎসবের দিন। পবিত্র ঈদ। তবে আনন্দের পরিস্থিতিটাই যেন পাল্টে গেছে হাহাকারে। এই ছবি যুদ্ধত্রস্ত প্যালেস্তাইনের। ইজরায়েলের মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণে রক্তস্নাত গাজা স্ট্রিপ। বিধ্বস্ত ইজরায়েলও।
২০১৪ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে এত বড়ো সংঘর্ষ আর দেখেনি পৃথিবী। উৎসবের মরশুম এভাবে যে রক্তিম হয়ে উঠবে, তা সোমবার সন্ধে অবধিও কেউ টের পেয়েছিল কি? সোমবার সন্ধেতে ইজরায়েলে রকেট নিয়ে হামলা চালায় গাজার জঙ্গি সংগঠন হামাস। লক্ষ্য তেল আভিভ। তারপর থেকে সাড়ে সতেরো শো’র-ও বেশি রকেট আছড়ে পড়েছে ইজরায়েলে। প্রাণ হারিয়েছে এক শিশু-সহ ৭ জন।
সোমবারের সেই রকেট-হামলার পর থেকেই পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে। প্যালেস্তাইনে লাগাতার আছড়ে পড়তে থাকে মর্টার আর রকেট। তার ওপরে বোমারু বিমানের হানা। ইজরায়েলের বায়ুসেনার বোমাবর্ষণে কার্যত ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে গাজা প্রদেশ। প্রাণ হারিয়েছেন সিটি কমান্ডার বসিম ইসার। নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১১৯। যার মধ্যে রয়েছে অন্তত ৩১ টি শিশু। আহত ৮৩০-এরও বেশি মানুষ। তাছাড়াও নিখোঁজ বহু মানুষ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় এখন শ্মশানের নীরবতা। প্রাণ বাঁচাতে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ শহর ছাড়ছেন। আশ্রয় নিচ্ছেন শরণার্থী শিবিরে। বিধ্বস্ত সেখানে অবস্থানরত সাংবাদিক এবং জাতিসংঘের আধিকারিকরাও। অন্যদিকে যুদ্ধপরিস্থিতিতে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি। দেশের একাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়েছে হিংসা। চরমে পৌঁছেছে ইহুদি এবং আরবীয়দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। কোথাও ইহুদিদের গণপ্রহারে সংকটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আরবীয় ট্যাক্সিচালক। আবার কোথাও আরবীয়দের গুলিতে নিহত ইহুদি ব্যক্তি। ফাটল ধরেছে বছরের পর বছর ধরে চলে আসে ইহুদি-মুসলিম সম্প্রীতিতে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আক্রে শহরে।
আরও পড়ুন
যুদ্ধের বিপরীতে অস্ত্র বই! অরুণাচল সীমান্তে ছাত্রদের হাতেই জন্ম নিচ্ছে লাইব্রেরি
অবশ্য ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশকে। সাম্প্রদায়িক হিংসা যে কোনোভাবেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়, সেই কথাই ফুটে উঠছে তাঁর কথায়। প্রয়োজনে কার্ফিউ জারি করার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
ভারত-চিন যুদ্ধের মাশুল গুনতে হতে পারে কাশ্মীরের শাল শিল্পকে, তৈরি হচ্ছে আশঙ্কা
তবে এত মৃত্যুর পরেও থামছে না দুই দেশের বিরোধ। ইজরায়েলের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে হামাস সম্পূর্ণ মুছে না গেলে যুদ্ধ থামার প্রশ্নই ওঠে না। অন্যদিকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত বলেই জানিয়েছে হামাস। বোমাবর্ষণের পর গতকাল আবারও নতুন করে ৭ হাজার পদাতিক সৈন্য গাজা সীমান্তে পাঠিয়েছে ইজরায়েল। পাঠানো হয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি, কামান-সহ অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র। বাড়ানো হয়েছে শেল-বর্ষণের মাত্রাও। প্রশ্ন থেকে যায়, এই চরমতম অহিংসার পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শান্তি ফেরাতে কোনো উদ্যোগই কি নিচ্ছে না বৈদেশিক শক্তিরা?
আরও পড়ুন
সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি ভারতীয় সেনার, অনুমোদন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর
মিশর ও কাতারের তরফে দূত পাঠানো হয়েছিল দুই দেশেই। আলোচনায় লাভ হয়নি কোনো। পাশাপাশি ঠিক পরিষ্কার নয় মিশরের অবস্থানও। কারণ একদিকে যখন শান্তিদূত পাঠাচ্ছে সেই দেশ, তেমনই হামাসের ‘প্রতিরোধী’ আক্রমণকেও খানিক সমর্থন দিয়েই কথা বলেছেন মিশরের বিদেশমন্ত্রী। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলের নৃশংস আক্রমণকে দেখছে ‘আত্মরক্ষা’ হিসাবেই। জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে এই অবস্থান জরুরী বলেই মনে করছেন মার্কিন কূটনীতিবিদরা। কিন্তু সত্যিই কি জঙ্গি নিকেশের জায়গাতেই থেমে রয়েছে এই বিবাদ? এখনও পর্যন্ত মাত্র ৮ জঙ্গি নিহত হয়েছে বলেই রিপোর্ট ইজরায়েলের। অর্থাৎ, নিহতদের প্রায় ৯০ শতাংশই নিরীহ প্রাণ, সাধারণ নাগরিক। বর্তমান হিংসার আবহে দাঁড়িয়েই তাঁরা প্রহর গুনছেন যুদ্ধবিরতির। দিন কাটাচ্ছেন চরম অনিশ্চয়তায়…
Powered by Froala Editor