ঠিক দুটো ছবি। একটিতে সাদা বরফের ওপর পড়ে আছে একটি ভাঙা প্লেন। এই ছবিটি পুরনো। ঠিক তার নিচের ছবিটি বরং সাম্প্রতিক। একই জায়গার ছবি তোলা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কোনো বরফের চিহ্নই নেই কোথাও! ধু ধু ফাঁকা জমি। তিংগুইরিরিকা আগ্নেয়গিরির বর্তমান দুরবস্থা পরিবেশের কথা তো তুলে আনছেই। সেই সঙ্গে তুলে আনছে ৪৮ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার প্রসঙ্গও।
একটু পেছনে যাওয়া যাক। ১৯৭২ সালে উরুগুয়ে থেকে একটি চার্টার্ড প্লেন চিলির সান্তিয়াগোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল। প্লেনের নম্বর ছিল ৫৭১। একটি রাগবি দলের ১৯ জন সদস্য, তাঁদের পরিবার, প্রিয়জন, ফ্যানরাও ছিল ওই প্লেনে। সব মিলিয়ে, মোট ৪৫ জন। হঠাৎই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্লেনটা ধাক্কা খায় আন্দিজ পর্বতের তিংগুইরিরিকা আগ্নেয়গিরির কাছেই একটি পাহাড়ে। দুটো ডানাই ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন বিমানকর্মী-সহ বেশ কিছু জন যাত্রী মারা যান। বাকিরা ওখানেই আটকে থাকেন।
এরপর শুরু হয় আসল ঘটনা। এই দুর্ঘটনার দশ দিনের মাথায় ট্রানজিস্টর মারফৎ খবর আসে যে, তাঁদের উদ্ধার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার ওপর খাবার নেই। নিজেদের মধ্যে ‘ভয়াবহ’ চুক্তি করলেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যারা আগে মারা যাবেন, তাঁদের মাংস খেয়ে বাকিরা বেঁচে থাকবেন! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। আর সেটা বাস্তবায়িতও হল। যে সঙ্গীটি প্লেনের পাশের সিটে বসেছিলেন, মারা যাওয়ার পর অবস্থার চাপে পড়ে তাঁরই মাংস খেতে হচ্ছে। কিন্তু, উপায়ই বা কি…
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর খাবারের অভাবে আরও লোক কমে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে পর্বতের প্রবল ঠান্ডা। আগ্নেয়গিরি অঞ্চল হলেও, ওখানে শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে ১৯১৭ সালে। তারপর, বরফের চাদরে ঢাকা। অবশেষে, দুর্ঘটনার ৭৩ দিন পর, ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছয় ওখানে। ততদিনে ৪৫ থেকে কমে ওঁরা হয়ে গেছেন ১৬! বাকিরা, তাঁদের পেটে…
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে ওই জায়গার বর্তমান ছবি। আর তাতেই হতবাক সবাই। কোথায় বরফ? খা খা করছে মাটি। চারিদিকে বিছানো নুড়ি কাঁকর। সমস্ত বরফ গলে গেছে। ঝলমলে রোদে সেই ছবি যেন একটা অভিশাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আন্দিজ পর্বতের বুকে একদিন বাধ্য হয়েই মানুষ মানুষকে খেয়েছিল। কিন্তু আজ, ক্রমশ পরিবেশকে দূষিত করে আমরা এই জায়গাগুলোকে শেষ করছি। এইভাবে এক এক করে বরফ গলে বেরিয়ে পড়ছে রুক্ষ মাটি। বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। আর সেটা হচ্ছে দ্রুতভাবেই। কীকরে বাঁচব তাহলে আমরা? শেষে এমন পরিস্থিতি কি তৈরি হবে না, যেখানে আমরাও একপ্রকার বাধ্য হয়েই ওই মানুষগুলোর মতো নিজেদের ‘মাংস’ নিজেরাই খাব? খাচ্ছি না, এটাই বা কে বলছে…