সময়োত্তীর্ণ ‘ডাস ক্যাপিটাল’-এর ১৫৬ বছর

তিন খণ্ডের একটি বই। যার প্রথম খণ্ড আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’বছর পর। অন্যভাবে বললে, লাইট বাল্ব আবিষ্কারের এক দশক আগে হামবুর্গের একজন প্রকাশকের হাত ধরে প্রকাশের আলো দেখে। বাল্ব যেমন চারপাশটা আলোয় রাঙায়, এই বইও তাই। তবে বইটির আলোয় কোনো একটি বিশেষ স্থান নয়, দীপ্ত গোটা বিশ্ব। ১৪ এপ্রিল, ১৮৬৭। কার্ল মার্কসের (Karl Marx) জীবৎকালে প্রকাশিত হয় ‘ডাস ক্যাপিটাল’-এর প্রথম খণ্ড। ১৮৮৩ সালে প্রয়াত হন মার্কস। তাঁর জীবদ্দশায় শুধুমাত্র এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী দু’টি খণ্ড তাঁর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস মার্কসের নোট এবং পাণ্ডুলিপি একত্র করে প্রকাশ করেছিলেন।

একটা সময় ছিল, যখন প্রকাশনা জগতে বেস্ট সেলারের তালিকায় প্রথম সারিতে বিচরণ করত এই ‘ডাস ক্যাপিটাল’ (Das Kapital)। তবে, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় পরিস্থিতি বদলায়। বেস্ট সেলারের তালিকা থেকে সরে গ্রন্থটি। কিন্তু বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার পর আবারো মানুষ মার্কসের এই এই কালজয়ী কাজকে স্মরণ করে। বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পুঁজিবাদ প্রকৃতিগতভাবে বিপন্ন ও ক্ষয়িষ্ণু ছিল। কেন এই হাল, এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা মানুষকে ফের ‘ডাস ক্যাপিটাল’-এর দিকে নিয়ে যায়।

২০০০ পৃষ্ঠার এই মহাকাব্যিক গ্রন্থটিকে সমসাময়িক বিশ্ব কত সহজে অপ্রাসঙ্গিক এবং পুরনো বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ৯০-এর দশকে মানুষ ফের একবার ‘ডাস ক্যাপিটাল’-কে গ্রহণ করার পর একটা বিষয় স্পষ্ট, একসময়ের সংগ্রাহকের এই ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ আসলে তার চেয়েও অনেক বেশি। ‘ডাস ক্যাপিটাল’-এর অলৌকিক পুনর্জন্মের এটাই মাহাত্ম্য। একইসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর পুরো দৃশ্যপটকে পালটে দেওয়ার মতো অনেক ঘটনার জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা বিস্মৃত হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে ‘ডাস ক্যাপিটাল’ ভবিষ্যতের মানচিত্র উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ পিছিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু গ্রন্থটিকে কোনো ভাবেই ‘অতীতের স্মৃতিচিহ্ন’ বলা যায় না। নিঃসন্দেহে ‘ডাস ক্যাপিটাল’ কার্ল মার্কসের মহাকাব্য, যা ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্তো প্রকাশের প্রায় দু-দশক পর প্রকাশিত হয়েছিল। তবে বইটিকে কেবল আর্থ-সামাজিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে বড় ভুল হবে।

ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং লেখক ফ্রান্সিস হুইন ‘ডাস ক্যাপিটাল’ সম্পর্কে লিখেছেন, বইটি ‘বিপ্লবী সাহিত্যের কোলাজ’। জার্মান সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট, আইজেনাখীয় পার্টির অন্যতম নেতা উইলহেম ব্রাকেকে ৫ মে, ১৮৭৫ সালে একটি চিঠিতে মার্কস লিখছেন, ‘বাস্তব আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপের গুরুত্ব ডজনখানেক কর্মসূচির চেয়ে বেশি। তাই আইজেনাখ কর্মসূচি অতিক্রম করে যাওয়া যদি সম্ভব না হয়ে থাকে এবং তখনকার অবস্থায় সত্যিই তা সম্ভব ছিল না। তাহলে উচিত ছিল সাধারণ শত্রুর বিরদ্ধে সংগ্রামের জন্য কেবল একটি চুক্তি করা। মূলনীতির কর্মসূচি (বেশ কিছুকাল মিলিত কাজের মধ্য দিয়ে প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে) রচনা করার ফলে গোটা দুনিয়ার সামনে এমন কতকগুলি নির্দেশক চিহ্ন দেওয়া হল, যা দিয়ে লোকে পার্টির আন্দোলনের স্তরকে পরিমাপ করবে। ঘটনাচক্র বাধ্য করেছিল বলেই লাসালীয় নেতারা এসেছিলেন। মূলনীতি নিয়ে কোনো দরাদরি চলবে না, একথা গোড়াতেই তাঁদের বলে দিলে, শুধু সংগ্রামের একটা কার্যক্রম বা মিলিত কাজের জন্য সংগঠনের একটি পরিকল্পনা নিয়েই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হত। তার বদলে তাঁদের ম্যান্ডেটে সুসজ্জিত হয়ে আসতে দেওয়া হল, নিজেদের পক্ষ থেকে সেইসব ম্যান্ডেটকে বৈধ বলে স্বীকার করে নেওয়া হল, এবং এইভাবে যাঁদের নিজেদেরই সাহায্য দরকার তাঁদের কাছেই করা হল বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ।... এখানে স্পষ্টই ছিল সমস্ত সমালোচনার কণ্ঠরোধ করার, নিজেদের পার্টিকে চিন্তা করার পর্যাপ্ত কোনো সুযোগ না দেবার একটা ইচ্ছা। মিলনের ঘটনাটুকুই শ্রমিকদের কাছে সন্তোষপ্রদ, একথা সুবিদিত। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী সাফল্যের জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতে হচ্ছে না একথা ভাবা ভুল।’ প্রসঙ্গত, এহেন ব্রাকে মার্কসবাদী এবং Lassallean নীতিতে যোগদান করেন। আগে তিনি প্রকাশক ছিলেন। সেখান থেকেই রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৮৭০ সালে, পার্টি কমিটি কর্তৃক যুদ্ধের বিরুদ্ধে জারি করা ইশতেহারের কারণে তাঁকে গ্রেফতার এবং একটি দুর্গে বন্দি করা হয়। তিনি গোথা কংগ্রেসে জমা দেওয়া খসড়া কর্মসূচির সমালোচনা করেছিলেন। ১৮৭৮ সালে অসুস্থতার কারণে তিনি দলীয় কাজ থেকে সরে আসেন।

আরও পড়ুন
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের 'অর্জুন’

একজন লেখক এবং চিন্তাবিদ হিসেবে মার্কস চরম আত্মবিশ্বাসে ভরপুর লেখক। আবার একইসঙ্গে তিনি আত্মসন্দেহে ভারাক্রান্তও। এই দুইয়ের অসাধারণ ভারসাম্য গোটা জীবন বজায় রেখেছিলেন মার্কস। ‘ডাস ক্যাপিটাল’-এর প্রথম পরিচ্ছেদে মার্কস বলছেন, যে সমস্ত সমাজে উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত থাকে, সেখানকার ধনসম্ভার প্রতীয়মান হয় ‘পণ্যের এক বিপুল সম্ভাররূপে’। সেক্ষেত্রে এক একটি পণ্য তার এক একটি একক। কাজেই আমাদের তত্ত্বজিজ্ঞাসা শুরু করতে হবে যে-কোনো একটি পণ্যের বিশ্লেষণ থেকে। পণ্য হল, প্রথমত, আমাদের বাইরে অবস্থিত একটি বস্তু, যা তার গুণাবলি দিয়ে মানুষের কোনো না কোনো অভাব পূরণ করে। সেই অভাবের প্রকৃতি কী তাতে কিছুই যায় আসে না। যেমন, তা উদর থেকেই আসুক আর কল্পনা থেকেই আসুক। এমনকী উক্ত বস্তু কীভাবে এইসব অভাব পূরণ করে— প্রত্যক্ষভাবে, জীবনধারণের উপাদান হিসেবে, নাকি পরোক্ষভাবে, উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে, তাও আমাদের জ্ঞাতব্য বিষয় নয়।

আরও পড়ুন
জার্মানির রাস্তায় পথ দেখাচ্ছেন কার্ল মার্ক্স, সঙ্গী এলভিস প্রেসলি!

প্রকাশকের কাছে তাঁর ‘ক্যাপিটাল: ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’ বইটি জমা দেওয়ার কয়েকদিন আগে এঙ্গেলসকে অনার ডি বালজাকের 'দ্য আননোন মাস্টারপিস' পড়তে বলেছিলেন মার্কস। এটা নিঃসন্দেহে তাঁর মনের অবস্থার পরিচায়ক। যদিও এঙ্গেলস তাঁর বন্ধুর পরামর্শ অনুসরণ করেছিলেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু গল্পটি মার্কসের মনে সে-সময় কী চলছিল, সেটা প্রকাশ করে। সৃজনশীল মানুষ বা শিল্পী অথবা কবিরা যদি অনুসন্ধান এবং পুনর্বিবেচনার মনোভাব নিয়ে থাকেন; মানুষ যদি ঈশ্বরের প্রতি সৎ থাকতে চান, তবে তাঁকে দ্বান্দ্বিক মনস্তত্ত্বের সম্মুখীন হতেই হবে। এর থেকে মুক্তি নেই। ব্যাপক অর্থে দ্বান্দ্বিকতার অর্থ দু’টি পরস্পরবিরোধী শক্তির সংঘাত। এই সংঘাত থেকে নতুন শক্তির উদ্ভব হয়। অন্যদিকে, ‘দ্য আননোন মাস্টারপিস' ছিল বিখ্যাত শিল্পী ফ্রাউনহোফারের গল্প। ১৮৩১ সালে প্রকাশিত এই বইটি মার্কস হয়তো পছন্দ করতেন। কারণ এতে বালজাক একজন শিল্পীর কষ্টকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গত, চিত্রকর্মটি নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়। যন্ত্রণাবিদ্ধ ফ্রাউনহোফার তাঁর সমস্ত চিত্রকর্ম পুড়িয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

সৌভাগ্যক্রমে, মার্কস বোকামি করেননি। বইটি লেখার সময় তিনি বালজাক ফ্রাউননহোফারকে যে কথাগুলি বলেছিলেন, তা পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন, ‘হায়! ক্ষণিকের জন্যও আমি ভাবতে পারি যে আমার কাজ শেষ হয়েছে। তবে আমি অবশ্যই কিছু বিবরণে ভুল করেছি এবং যতক্ষণ না আমার সন্দেহ দূর হচ্ছে, ততক্ষণ আমার মন শান্ত হতে পারে না।’ বিয়ারম্যানের মতে, ফ্রাউনহোফারের ক্যানভাসের বালজাকের বর্ণনা ২০ শতকের বিমূর্ত চিত্রের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, এক যুগের বিশৃঙ্খলা ও অসংগতি অন্য যুগে অসাধারণ অর্থ ও সৌন্দর্যে রূপান্তরিত হতে পারে।

একটি ক্ষেত্র যেখানে ‘ডাস ক্যাপিটাল’ আমাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে সহায়ক প্রমাণিত হতে পারে, তা হল এর আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণের শক্তি। একইসঙ্গে কাব্যিক এবং নিরপেক্ষ এই বিষয়টি এমন একটি ভিত নিয়ে দাঁড়িয়ে, যখন অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে উৎপাদনের উপায়ের উপর মালিকানা অধিকতর কেন্দ্রীভূত। অর্থনীতি নতুন ধরনের উৎপাদনে বিকশিত হচ্ছে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সেবা। এমন পরিস্থিতিতে, যাঁরা সর্বহারা বা সমতাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তাঁদের কাছে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে পুঁজির এই প্রাসঙ্গিকতা আরো তীব্র। কারণ মার্কস বর্ণিত পুঁজিবাদী উৎপাদনের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য— উৎপাদনের উপায়ের ঘনত্ব, শ্রমের সংগঠন এবং বিশ্ববাজারের উত্থান। যদিও এই তিন উপাদান সামান্যই পরিবর্তিত হয়েছে। সমস্যা হল, মার্কস-পন্থীরা একে সমস্ত রোগের নিরাময় হিসেবে ভেবে বসে ভুল করেছিলেন। ‘ডাস ক্যাপিটাল’-কে আরো কয়েক শতক প্রাসঙ্গিক রাখতে গেলে একে ধর্মোপদেশ হিসেবে ভাবা বন্ধ করে দেখতে হবে রেফারেন্স টেক্সট হিসেবে। মার্কসের কাছে পুঁজিবাদ ছিল একটি রূপক। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, পণ্যের মূল্য যদি নির্ধারিত হয় যে-পরিমাণ শ্রম তার জন্য ব্যয় করা হয়েছে তা দিয়ে, তাহলে তো শ্রমিক যত বেশি অলস এবং অপটু হবে, তার পণ্য হবে তত বেশি মূল্যবান। কারণ সেক্ষেত্রে উৎপাদন কার্যে তার লেগে যাবে বেশি সময়। যে শ্রম-মূল্য সৃষ্টি করে, তা অবশ্য সমজাতিক মনুষ্য-শ্রম। এক ও অভিন্ন শ্রমশক্তির ব্যয় এই মনুষ্য-শ্রম। সমাজ থেকে উৎপন্ন সমস্ত পণ্যের মোট মূল্যের ভিতর যে পরিমাণ শ্রমশক্তি আছে, এখানে সমাজের সেই মোট শ্রমশক্তিকে ধরা হচ্ছে মানুষের শ্রমশক্তির একটি সমজাতিক স্তূপ হিসেবে। সেই স্তূপটি অবশ্যই অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন এককের সমষ্টি। প্রতিটি এককই অবিকল অন্য অরেকটি এককের মতো। তার চরিত্র ও কার্যকারিতা সমাজের গড় শ্রমশক্তির অনুরূপ। এভাবে চিন্তা করলে ‘ডাস ক্যাপিটাল’ অনন্য। যার আগে বা পরে এমন কোনো বই নেই। যার তুলনা সত্যিই বিরল।

তথ্যঋণ:
১. ক্যাপিটাল ১ম খণ্ড - কার্ল মার্কস, বাংলা অনুবাদ আখতার হোসেন। প্রকাশক: বাণীপ্রকাশ।
২. কাল মার্কস ফেড্রারিক এঙ্গেলস - রচনা-সংকলন (দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ), দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম অংশ। প্রকাশক: ধ্রুপদী।
৩. Past Continuous: Karl Marx’s ‘Capital’ Can Help Unravel the Perplexities of Modern-Day Capitalism - Nilanjan Mukhopadhyay.

Powered by Froala Editor