শিয়ালদহ মেন লাইন ধরে কলকাতা থেকে ভেতরের দিকে যাচ্ছেন আপনি। নৈহাটি ছেড়ে ট্রেন এগোচ্ছে হালিশহরের দিকে। দু’পাশে সবুজ। রয়েছে জলাভূমি, চাষের জমিও। শিয়ালদা থেকে নৈহাটি পর্যন্ত পথে আপনি রেললাইনের দু’পাশে শহুরে ছাপ এড়াতে পারেননি পুরোপুরি। নৈহাটির পরেই বদলে গেল দৃশ্য। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন আপনি। কিংবা ট্রেনের দরজায়; হাতল ধরে শরীর খানিক ঝুলিয়ে রেখেছেন বাইরে। হালিশহরও গেল। হঠাৎ দেখলেন, রেলপথের দু’পাশে সাহেবি আমলের কিছু বিল্ডিং। লাল রং আর ব্রিটিশ স্থাপত্য দেখে সহজেই এসব ধরতে পেরে যান আজকাল। একটা স্টেশন, ফাঁকা-ফাঁকা, ছুট্টে পিছিয়ে গেল। গলা বাড়িয়ে অতিকষ্টে নামটা পড়লেন – ‘কাঁচরাপাড়া কারখানা গেট’। থামল না কেন? লোকজন এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে। কাঁচরাপাড়া এল। দু’দিকেই স্টেশন। যে-কোনো দিক দিয়ে নামলেই হল। শিয়ালদার পর, মেন লাইনে এমনটাও কি আর দেখেছেন!
১৮৬৩ সালে সাহেবরা কাঁচরাপাড়ায় তৈরি করে একটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ।
শিয়ালদা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলপথ চালু হয় ১৮৬২ সালে। তখনই তৈরি হয় কাঁচরাপাড়া স্টেশন। আর, তার একবছর পরেই, ১৮৬৩ সালে সাহেবরা কাঁচরাপাড়ায় তৈরি করে একটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। তখন অবশ্য জায়গাটা বীজপুর নামে পরিচিত ছিল। বীজপুরে জমি অধিগ্রহণ করে ওয়ার্কশপ বানায় সাহেবরা। অবশ্য বীজপুর এলাকাও কাঁচরাপাড়ার গা ঘেঁষেই। ও’ মেলি বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে লিখেছিলেন – ‘Kancharapara is also called Bijpur.’
প্রায় ১,৩২,০০০ বর্গমিটার জমির ওপর তৈরি করা হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের এই ওয়ার্কশপ। সে-আমলে সারা ভারতে কাঁচরাপাড়ার ওয়ার্কশপের খ্যাতি ছিল। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টেকনিক্যাল স্কুলের ছাত্ররা ট্রেনিং নিতে আসত এখানে। ওয়ার্কশপ স্থাপনের পর, একে একে লোকোশপ, ক্যারেজ আর ওয়াগন শপ তৈরি করা হয়। লোকোশপে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের কাজ করা হত। ক্যারেজে মেরামত করা হত কাঠের ওয়াগন। আর ওয়াগন শপে খোদ ওয়াগন তৈরি হত। সেসব দিন আর নেই। এখন ওয়াগন শপ আর ক্যারেজ বন্ধ। শুধুমাত্র ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনের কাজ হয় সেখানে। আর লোকাল ট্রেন মেরামত করা হয়।
১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘বাংলায় ভ্রমণ’ বইতেও সগৌরব উল্লেখ আছে কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপের – ‘এই স্থানে পূর্ব্ব-বঙ্গ রেলের ইঞ্জিন মেরামত ও গাড়ী তৈয়ারী করিবার কারখানা অবস্থিত। বড় মাপের লাইনের সমস্ত গাড়ীই এখানে প্রস্তুত হয়। ...কাঁচরাপাড়ার রেলওয়ে উপনিবেশ একটি সুদৃশ্য শহর। উদ্যান, ক্রীড়াক্ষেত্র, রাজপথ, বিদ্যুদালোক, কলের জল, বিদ্যালয়, ভজনাগার, প্রমোদগৃহ কোন কিছুরই এখানে অভাব নাই।’ আজও কারখানা গেট পেরিয়ে কাঁচরাপাড়ার দিকে যেতে যেতে ট্রেন থেকেই দেখতে পাবেন ডানদিকে সুসজ্জিত শহর, কোয়াটার্স, খেলার মাঠ। সচরাচর দৃশ্যের থেকে খানিক আলাদা। সাহেবি ছাপ ও যত্নটুকু মুছে যায়নি আজও।
আজও সকালে অফিস টাইমে দুটি মাত্র লোকাল ট্রেন দাঁড়ায় কারখানা গেট স্টেশনে। একটি শিয়ালদা থেকে কল্যাণী সীমান্তগামী, অন্যটি কল্যাণী সীমান্ত থেকে শিয়ালদাগামী।
পাশাপাশি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রও তৈরি হত ওয়ার্কশপটিতে। কাঁচরাপাড়া ও তার সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিগ্রহণ করে আমেরিকান মিলিটারিরা তাদের ক্যাম্প বসায়।
১৮৬৩ সালে ওয়ার্কশপ তৈরির পাশাপাশি, কর্মীদের বসবাসের জন্য গড়ে ওঠে চারটি কলোনিও। ইংরেজ অফিসারদের জন্য অফিসার্স কলোনি, ফোরম্যানদের জন্য ফোরম্যান কলোনি, রেলের বাবুদের জন্য বাবু ব্লক আর সাধারণ কর্মীদের কলোনি। এছাড়াও, যারা নিয়মিত যাতায়াত করত, কারখানার সেইসব কর্মচারীদের জন্য তৈরি করা হয় একটি স্টেশনও। ‘কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপ গেট’। মূল কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই কারখানা গেট স্টেশন। ছিমছাম স্টেশনদুটিতে নেই কোনো স্টেশন মাস্টার, রেলকর্মী। নেই টিকিটঘরও।
আজও সকালে অফিস টাইমে দুটি মাত্র লোকাল ট্রেন দাঁড়ায় কারখানা গেট স্টেশনে। একটি শিয়ালদা থেকে কল্যাণী সীমান্তগামী, অন্যটি কল্যাণী সীমান্ত থেকে শিয়ালদাগামী। এছাড়া টাইমটেবিলে কোত্থাও জায়গা নেই এর। ওয়ার্কশপের চাকুরে ও কর্মচারীরা সেই ট্রেনদুটিতেই যাতায়াত করেন। এভাবেই দেড়শো বছর আগেকার একটি ঐতিহ্য টিকে রয়েছে। যদি কখনও ভাগ্যক্রমে তেমন কোনো ট্রেনে উঠে পড়েন, থামলে দেখবেন শুনশান কারখানা গেট স্টেশনের চেহারা। যেন বৈমাত্রেয় ভাই; অন্যদের সমবয়েসি হলেও শিয়ালদা ডিভিশন তাকে সঠিক মর্যাদা দিল না কোনোদিন...
ছবি সৌজন্য - indiarailinfo.com