পলাশীর যুদ্ধের পর ক্লাইভ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, হাজার-হাজার মানুষ পথের দু-পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তারা যদি সামান্য লাঠি নিয়ে বা ঢিল ছুড়ে প্রতিবাদ করত আর তাড়িয়ে দিত, তাহলেই ক্লাইভদের স্বপ্নের রথ ভেঙে গুঁড়িয়ে যেত। তারা তা করেনি। তাহলে? সোজা হিসেব এই যে, তারা চেয়েছিল, ক্লাইভ আসুক। গান্ধীজি খুব সঙ্গত কারণেই বলেছিলেন, কেউ কারও স্বাধীনতা খোয়ায় না - no man looses his freedom except through his own weakness. অর্থাৎ, জেনেবুঝেই মানুষ পরাধীন হয়। খাঁটি কথা। সার্ত্রেও বলেন, man is supposed to be the maker of his own destiny.
গান্ধী সম্পর্কে কেন জানি না, একটা বিরূপ হাওয়া আমাদের এদিকে ঘোরাফেরা করে। সাম্প্রতিক জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভ নির্মাণের কারণে ততটা নয়, মনে হয়, অনেকটাই সুভাষচন্দ্রের জন্য। সে আলাদা প্রসঙ্গ এবং নিশ্চিত তার ঐতিহাসিক বাস্তবতাও আছে। স্বয়ং গান্ধীও তো প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু এই যে দুর্বলতা, যা-কিনা পরাধীনতা স্বীকার করতে আমাদের রাজি করায়, তা অতিক্রমের পথ হিসেবে সুভাষের থেকেও গান্ধীজির পন্থাই মনে হয় অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী এবং দিশারি, অন্তত এখনকার প্রেক্ষিতে তো বটেই। মানুষই শক্তির উৎস, তা চালিত করা ভিন্ন দ্বিতীয় রাস্তা নেই। গান্ধীর এই মত ও পথ, বিশ্বের সমস্ত নেতারাই স্বীকার করেছেন, সে লেনিন হোন বা মাও। এবং সেই মানুষের শক্তিকে অন্তত দু-রকম আলোয় দেখা যায়। এক, গণআন্দোলনের শক্তি যেভাবে আইডেন্টিটি তৈরি করে দিতে পারে, তা জাতির রক্ষাকবচ। ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ থেকে যা অনেকাংশে আলাদা। বিদেশি ছাঁচ থেকে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম, তা ভারতবর্ষের মতো দেশের মূল সমস্যাগুলোকে দূর তো করনি, চাপা দিয়েছে মাত্র। আজ যখন কোনো রাজনৈতিক দল সার্থকভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করতে পারে, তখন স্পষ্ট হয় যে, এই জাতীয়তাবাদ ভারতকে গোড়া থেকে বাঁধতে পারেনি। সেখানেই কৃষক শ্রেণি থেকে আন্দোলন তুলে আনায় জোর দিয়েছিলেন গান্ধী। বস্তুত ভারতের লৌকিক জনজীবনকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো জাতীয়বাদই সদর্থে মানুষের শক্তি হয়ে উঠতে পারে না।
দ্বিতীয়ত আলোচ্য, ব্যক্তি মানুষের শক্তি। যা আমার কাছে আজকের সময়ে খুব জরুরি মন হয়, বিশেষত যখন নানা ছলছুতোয় ব্যক্তি আর সমষ্টির ধারণা ক্রমাগত গুলিয়ে দেওয়া হয় বা আমার কাছে গুলিয়ে যায়। ঠিক এরকমই সংশয়-মুহূর্তে দেখি, গান্ধী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উপর জোর দিয়েছিলেন তো বটেই, কিন্তু তা-ঠিক অন্য দেশের থেকে তুলে আনা ব্যক্তির ধারণা মোতাবেক নয়। যে-ব্যক্তির ধারণা ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক করে তুলল গোটা পৃথিবীকে এবং আদপে ধনতন্ত্রের বিকাশের সুযোগ করে দিল, সেই ব্যক্তির উপর জোর দেওয়ার কথা তো কেউ-ই বলেননি। না রবীন্দ্রনাথ, না গান্ধী, না সার্ত্রে। এমনকি যে মার্কসের সঙ্গে গান্ধীর দর্শনের আপাত বিরোধ অনেক সময় আলোচিত হয় নানা জায়গায়, তাঁরা দুজনেই ফিরেছেন সেই ব্যক্তিতে, যে ব্যক্তি উন্নত সমাজের সূচক। এখন এই উন্নত সমাজ অবশ্যই উন্নত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। কিন্তু তারা কারা? বাইরের দেশে এই ব্যক্তির ধারণা অনেকসময়ই ধনসম্পদে উন্নত ব্যক্তিকে আমাদের সামনে খাড়া করে। আর, গান্ধীর বলা ব্যক্তির শক্তি হল, তার নৈতিকতা। গান্ধী সেই ক্ষমতা-ই চেয়েছিলেনন, যা ব্যক্তিকে নৈতিক ও আত্মিকভাবে সমর্থ ও শক্তিশালী করে তুলবে। রবীন্দ্রনাথও উপনিষদের শ্রেয়-তে বিশ্বাস করেন, যেখানে ব্যক্তি গুরুত্ব পায়, কিন্তু তা আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি নয়, বরং সমাজলগ্ন ব্যক্তি। ফলে কিছু দায়বদ্ধতা তাকে পালন করতে হয়। কিছু নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুশীলন নিয়ত করতেই হয়। এই ব্যক্তির শক্তিই মূলত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, আত্মিকভাবে ও নৈতিকভাবে। এবং তা হতে পারে অমিত ক্ষমতাশালী, রাজনৈতিকভাবেও। কারণ এখানে নীতি আর রাজনীতি এক হয়ে যাচ্ছে। গান্ধী তাই বলেন, " I have no desire to exchange 'king for the king stock', Hence for me the movement of swaraj is a movement of selfpurification.’
এই আত্মশুদ্ধ ব্যক্তি যখন সামগ্রিক জাগরণে অংশ নেয়, তা সর্বার্থেই একটা জাতিকে আইডেন্টিটি দিতে পারে। গান্ধীর এই যে ক্ষমতার ধারণা, ব্যক্তির ক্ষমতা এবং সামগ্রিকের ক্ষমতা, অথচ যা ঠিক চলতি অর্থ-ধর্ম-কামের ক্ষমতা নয়, তা আজ আরও বড় বেশি জরুরি বলে মনে হয়। কেন-না সন্দেহ নেই, সেই পলাশীর যুদ্ধের পরের ঘটনার মতোই, আজও অনেক কিছুই হচ্ছে যেখানে হাততালি দেওয়া উচিত নয়, আমরা তবু দিচ্ছি। অথবা আমরা এখনও ওই ঢিল ছুড়ে তাড়ানোর আয়োজন করছি না। ফলত, প্রকারন্তরে আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি যে, আমরা ওই ঘটনা মেনে নিতে আগ্রহী। এবং সেই সঙ্গে গান্ধী ও তাঁর দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করতেও।
হ্যাঁ, ২ অক্টোবর তবুও পালিত হচ্ছে, হয়তো সাড়ম্বরেই।