নোবেলের কাছাকাছি গিয়েও ফিরতে হয়েছিল যে ১৪ জন বাঙালিকে

মাসকয়েক আগে, নোবেল পুরস্কার জিতে বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন এবং মহম্মদ ইউনুস। অর্থনীতিতে এখনো পর্যন্ত বঙ্গসন্তানদের ঝুলিতে দু'টি নোবেল। যদিও বিশ্বসেরার মনোনয়নে বাঙালির নাম বহুবার উঠেছে। ঠিকই বলছি, বহুবার। কিন্ত স্বীকৃতির দরজায় কড়া নাড়লেও অধরা থেকেছে স্বপ্ন।

আরও পড়ুন
আনতে যেতে হয়নি, নোবেল-ই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে

১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সুইডিশ নোবেল কমিটি একাধিকবার বাতিল করেছে বাঙালির নাম। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে কে না চেনে! তাঁর নামই মনোনীত হয়েছে ৭ বার। এখনো পর্যন্ত সর্বাধিক। তারপরেই রয়েছেন পদার্থবিদ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। সত্যেন্দ্রনাথ সম্পর্কে এই লেখায় কিছু বলাই বাতুলতা। তুলনায় কম আলোচিত উপেন্দ্রনাথ বাংলার ধন্বন্তরিদের একজন। অধুনা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে বসে আবিষ্কার করেছিলেন কালাজ্বরের প্রতিষেধক। একটা গোটা দেশকে মহামারীর হাত থেকে বাঁচানোর খবর নোবেল কমিটি শুনেছিল নিশ্চয়। তাই একই বিভাগে পাঁচবার মনোয়ন পেয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ।

আরও পড়ুন
নোবেল কমিটির ডাকে বক্তৃতা দিলেন এই বাঙালি চিকিৎসক, পেলেন না পদক

শান্তি পুরস্কারের জন্য চারবার মনোনীত হয়েছিল সঞ্জীব চৌধুরীর নাম। ইংরেজির অধ্যাপক সঞ্জীববাবু শিক্ষকতা করেছেন তিনটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে। 'ভারত-পাকিস্তানের পুনর্মিলন' বিষয়ক নানা প্রবন্ধ লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। শ্রীচৌধুরী ব্যতীত আরো দু'টি নাম শান্তি পুরস্কার বিভাগের দৌড়ে এগিয়ে ছিল। ৩০-৪০ দশকের মাঝে একাধিকবার মনোনয়ন পেয়েছেন হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও নলিনীকুমার মুখোপাধ্যায়। দুজনেই অধ্যাপনা করতেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেকালের বিশ্ব শান্তি বিষয়ক নানা পুরোনো পুস্তিকার পাতায় পাওয়া যাবে এঁদের রচনা। তবে বাঙালি মননে এঁরা ব্রাত্য। কারও পূর্ণাঙ্গ জীবনী নথিবদ্ধ নেই।

১৯৪৩ সালে কমিটির কাছে এসেছিল ঋষি অরবিন্দ ঘোষের নামটিও। শান্তি  ও সাহিত্য বিভাগে। কিন্তু ভারতীয় অধ্যাত্মবাদকে ইউরোপীয়রা খানিক সন্দেহের চোখেই দেখে এসেছে। সুতরাং অন্তিম তালিকা অবধিও যেতে পারেননি তিনি।

মহিলাদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত মনোনীত হয়েছেন 'দ্বিখণ্ডিত’র রচয়িতা তসলিমা নাসরিন, এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে মহাশ্বেতা দেবী। মৌলবাদের বিরোধিতা করে দেশ থেকে বিতাড়িত তসলিমা আজও এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে মহাশ্বেতার নাম উঠে এসেছে তিনবার। তবে 'হাজার চুরাশির মা' - 'অরণ্যের অধিকার'-এর লেখিকা পেয়েছিলেন 'এশিয়ার নোবেল' অথবা 'র‍্যামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার'। ২০১২ সালে তালিকায় তাঁর নামের পাশে পাওয়া যাবে 'সনেট মণ্ডল'কে। দুর্গাপুরের বাসিন্দা সনেট নীরবে লিখে চলেছেন কবিতা। এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত ছয়টি কাব্যগ্রন্থ। তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে পাঁচটির বেশি ভাষায়। পেয়েছেন বহু দেশি-বিদেশি সাহিত্য পুরস্কার। উত্তর-আধুনিক যুগের তরুণ কবি সনেটের বাংলার বাইরেই পরিচিত বেশি...

এছাড়া রয়েছেন আরো চারজন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি সাহিত্য বিভাগে জ্বলজ্বল করছেন রবি দত্ত। ১৯৩৭ সালে ওই বিভাগেই উঠেছে বেনসাধর মুখোপাধ্যায়ের নাম। দাসমণি রায় ও বিনাজ নারায়ণ সেনকেও দেখা যায় 'নোবেল শান্তি পুরস্কারে'র তালিকায়...

কিন্ত এঁদের সম্পর্কে নূন্যতম তথ্যও পাওয়া যাবে না চরিতাভিধানে। চাপা পড়ে রয়েছেন ইতিহাসের অন্তরালে। ঠিক যেভাবে অনেক বাঙালিকে ভুলে গেছি আমরাও, যথেষ্ট প্রচারের আলোয় না থাকার কারণে। কিন্তু তাঁদের কাজকে ইতিহাস অস্বীকার করতে পারেনি কিছুতেই। নোবেল না পান, নোবেলের মনোনয়ন তালিকায় পৌঁছে যাওয়াও কি কম কথা!