যুদ্ধ তো পৃথিবী অনেক দেখেছে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে মাত্র দুটো। প্রথমে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে উপনিবেশ দখলের লড়াইতে নেমেছিল জার্মানি, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সেই উপনিবেশের ধারণাটাই শেষ করে দিয়েছিল। হ্যাঁ, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স কারোর পক্ষেই আর বড় সাম্রাজ্য ধরে রাখার মতো শক্তি ছিল না। ফলে এক এক করে আমাদের দেশ ভারতবর্ষের মতোই স্বাধীনতার আলো দেখতে শুরু করে পৃথিবীর অন্যান্য উপনিবেশগুলিও। ঠিক এই সময়েই ঘটল একটি ঘটনা।
ফরাসি আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার দিন গুনছে আফ্রিকা। সবটাই মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু যেমন সহজভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে তো হল না। ফ্রান্স সরকার অবশ্য সমস্ত ফরাসি কর্মচারীদের দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিল। কিন্তু সেইসঙ্গে দিল আরও একটি নির্দেশ। কর্মচারীরা নিজেদের সঙ্গে যতটা অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যেতে পারবে, সমস্ত নিয়ে যাওয়া হবে ফ্রান্সে। আর যতটা পারবে না, যা স্থাবর সম্পত্তি; সেই সমস্তকিছু নষ্ট করে দেওয়া হবে। যেমন নির্দেশ তেমনই দায়িত্ব পালন করল কর্মচারীরা। একের পর এক স্কুল, হাসপাতাল, নার্সারিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া শুরু হল। সেই আগুনের হাত থেকে রেহাই পেল না বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলিও।
এই পরিস্থিতিতেই শুরু হল বিশ শতকের নতুন ধরনের ঔপনিবেশিক কাঠামো। না, পুরনো কাঠামোর সঙ্গে তার মিল বিশেষ নেই। সরাসরি কোনো শাসনযন্ত্র নেই। কিন্তু আধিপত্যটা থেকে গিয়েছে। আসলে একের পর এক সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দেশে যখন তাণ্ডব চালাচ্ছে ফরাসি বাহিনী, তখন একটা সমঝোতার রাস্তা খুঁজলেন টোগো প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট সিলভানাস অলিম্পিও। আফ্রিকার অসংখ্য ছোটো দেশের থেকেও ছোটো একটি দেশ টোগো। যুদ্ধে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চুক্তি দ্বারা স্থির হল, অবাধ স্বাধীনতার বিনিময়ে প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দিতে বাধ্য থাকবে টোগো সরকার। আর সেই খাজনার পরিমাণটা? ১৯৬৩ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশই তুলে দেওয়া হয়েছিল ফ্রান্সের হাতে।
সিএফএ ফ্রাঙ্ক, অর্থাৎ আফ্রিকার ১৪টি দেশ থেকে ফরাসি সরকার যে খাজনা আদায় করে, তার পরিমাণটা আজকের হিসাবেও রীতিমতো চোখ বড়ো করার। প্রতি বছর এভাবেই আয় হয় অন্তত ৫০০ বিলিয়ন ডলার। ফ্রান্সের জাতীয় আয়ের একটা বড়ো অংশই নির্ভর করে থাকে এই খাজনার উপর। তাই ২০০৮ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক চিরাক বলেছিলেন, আফ্রিকা না থাকলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ফ্রান্স প্রথম কুড়িটি দেশের তালিকার মধ্যে থাকবে না। প্রায় একই কথা ১৯৫৭ সালেই বলেছিলেন ফ্রান্সিস মিটারেন্ড। তবে আফ্রিকার দেশগুলো যে এই আধিপত্য খুব সহজে মেনে নিয়েছিল, তা নয়। বরং বারবার প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে সেখানে। আর তার ফল হয়েছে ষাট ও সত্তরের দশকের মধ্যে ৬০টির বেশি গুপ্তহত্যা এবং পরিকল্পিত সংঘর্ষ। আর প্রবল পরাক্রমী ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতাও নেই আফ্রিকার ছোট দেশগুলির।
তাই আজও যখন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে জনবিরোধী নীতি প্রণয়নের অভিযোগ ওঠে, তখন হয়তো আমরা মূল কারণটার দিকে তাকাতে ভুলে যাই। এই বিপুল পরিমাণ খাজনার বোঝা মাথার উপর না থাকলে হয়তো অনেক সরকারই দেশের মানুষের কথা ভাবার অবকাশ পেত। কিন্তু আজকের নতুন সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি সেই সুযোগ তো দেয়নি। তাই আফ্রিকার কালো মানুষদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে এগিয়ে চলেছে ইউরোপের রথ। যদিও সময় বদলাচ্ছে ক্রমশ। প্যান আফ্রিকা আন্দোলনের মাধ্যমে সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে মানুষ। আর এর মধ্যেই উগান্ডা এবং নাইজেরিয়ায় দাবি উঠেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সাক্ষী সমস্ত রাস্তা, স্থাপত্য এবং জায়গার নাম বদলে ফেলতে হবে। আফ্রিকায় যেন নতুন করে শুরু হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন। আর ফ্রান্স সরকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার জাতীয় মুদ্রার পরিবর্তন করবে। সেক্ষেত্রে হয়তো খাজনার বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে ১৪টি দেশ। সুদিনের গল্প কি এখনও স্বপ্নের মতো শোনাচ্ছে?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
আফ্রিকান ক্রীতদাস থেকে দাক্ষিণাত্যের ‘কিং মেকার’, আওরাঙ্গাবাদের প্রতিষ্ঠাতা মালিক অম্বর