মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ঘোস্টওয়্যারের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে অগণিত সামুদ্রিক প্রাণী। তাছাড়াও প্রতিদিন মানুষের শিকার হচ্ছে ডলফিন, তিমি, হাঙর, কচ্ছপের মতো বিরল সামুদ্রিক প্রজাতি। এইসকল প্রাণীদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও, বাস্তবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না কিছুই। এবার সে-কথাই প্রমাণ করল অ্যারিজোনার স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণা। বিগত ৩০ বছর সবমিলিয়ে প্রায় ১১ লক্ষ সামুদ্রিক কচ্ছপকে (Sea Turtle) অবৈধভাবে হত্যা করা হয়েছে, এমনটাই জানাচ্ছেন গবেষকরা।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৫ দেশে দেখা গেছে এই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। বছর-পিছু প্রতি দেশে প্রাণ হারিয়েছে ৪৪ হাজারের বেশি সামুদ্রিক কচ্ছপ। যদিও বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই ধারণা গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জেসি সেনকোর। আসলে নির্ভুলভাবে অবৈধ প্রাণী-হত্যার পরিসংখ্যান নির্ণয় সহজ কাজ নয় মোটেই। বিগত তিন দশকে প্রকাশিত ২০৯টিরও বেশি পিয়ার-পর্যালোচিত বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনাবলীর উপর ভিত্তি করেই এই পরিসংখ্যান নির্ণয় করেছেন গবেষকরা। অর্থাৎ, যে-সকল ক্ষেত্রে কচ্ছপের মৃতদেহ পাচারের সময় ধরা পড়েছে, কেবলমাত্র তাদের উপর ভিত্তি করেই এই পরিসংখ্যান। কিন্তু কেন নির্বিচারে কচ্ছপ শিকার চলছে বিশ্বজুড়ে?
স্থানীয় বাজারে সাধারণত মাংসের জন্যই হত্যা করা হয় কচ্ছপকে। তবে তা নদী কিংবা মিষ্টি জলের জলাশয়ের কচ্ছপ। সামুদ্রিক কচ্ছপ বহু অঞ্চলে খাওয়া হলেও, মূলত সেগুলির শিকার করা হয় ঔষধশিল্পের জন্য। সামুদ্রিক কচ্ছপের খোল অর্থাৎ পিঠের বর্ম দিয়ে তৈরি হয় একাধিক ওষুধ। তাছাড়াও গহনা কিংবা ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরির ক্ষেত্রে হাতির দাঁতের মতোই ব্যবহার করা হয় কচ্ছপের খোল। জাতিসংঘের মতে, প্রতিবছর গোটা বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ব্যবসা চলে অবৈধ কচ্চপ-পাচারের।
গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত এই নতুন গবেষণাপত্র অনুযায়ী, মাদাগাস্কার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই সামুদ্রিক কচ্ছপ শিকারের হটস্পট হয়ে উঠেছে বর্তমানে। তাছাড়াও চিন, জাপান, ভিয়েতনামে রয়েছে কচ্ছপ-জাত পণ্য তৈরি ও বিক্রির সবচেয়ে বড়ো বাজার। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল উন্নত দেশগুলিতে কচ্ছপের শিকার তুলনামূলকভাবে কম হলেও, সেখানেই কচ্ছপ-জাত বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিশেষত সম্ভ্রান্ত পরিবারের কচ্ছপ-জাত পণ্য বর্তমানে হয়ে উঠেছে আভিজাত্যের প্রতীক।
বিশ্বজুড়ে শিকার হওয়া কচ্ছপের প্রায় ৯৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে মূলত দুটি কচ্ছপ প্রজাতি— গ্রিন সি টারটেল এবং হকসবিল টারটেল। উল্লেখ্য, এই দুটি প্রজাতিই বর্তমানে বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের তালিকায় অন্তর্গত। অর্থাৎ, অবৈধ শিকার ও পাচার ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে এই প্রজাতি দুটিকে। গত ১০ বছরে দুটি প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপেরই গড় জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক আইনের পাশাপাশি প্রতিটি দেশে পৃথকভাবে সংরক্ষণ প্রকল্প ও সুরক্ষা-আইন প্রণয়ন না করলে, এই দুই প্রজাতির অবলুপ্তি ঠেকানো সম্ভব নয় বলেই দাবি গবেষকদের। সেক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে উন্নত দেশগুলিকেই। ধনী দেশগুলিতে যতদিন চাহিদা থাকবে কচ্ছপ-জাত পণ্যের, ততদিন অবিরামভাবেই চলবে এই নির্বিচার হত্যালীলা…
Powered by Froala Editor