“পুজোর মাস কয়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। মনে হয়, যেন বাড়ির কোনো সদস্য আসছেন প্রবাস থেকে। আবার বিসর্জনের সময়েও প্রিয়জন চলে যাওয়ার মতো মনখারাপ হয় আমাদের…”
বলছিলেন অদ্রিজা ভট্টাচার্য। বসিরহাট থেকে কয়েক মাইল দূরে উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়া থানার বর্ধিষ্ণু গ্রাম আড়বালিয়া (Arbalia)। বনেদি বাড়ির পুজোর কথা উঠলে ছোট্ট এই গ্রামের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। হ্যাঁ, কলকাতার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে না এই গ্রামের রাস্তায়। বরং, আড়বালিয়ায় পা রাখলে আক্ষরিক অর্থেই গন্ধ পাওয়া যায় শরতের। দুর্গাপুজোয় গম গম করে ওঠে সেখানকার শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িগুলি। যার মধ্যে অন্যতম ‘হাঁস ঠাকুরের বাড়ি’ বা ব্রাহ্মণবাড়ির পুজো। অদ্রিজা সেই বাড়িরই সদস্য।
অবশ্য শুধু বনেদিয়ানা বা দুর্গাপুজোই নয়, এই বাড়ির শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতাতেও। অগ্নিযুগের স্বাধীনতা সংগ্রামী অবিনাশ ভট্টাচার্য (Abinash Bhattacharya) এই বাড়িরই সদস্য। বিপ্লবী, চিন্তক, দার্শনিক, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবক এবং কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (M. N. Roy) জন্মও এই বাড়িতেই। হ্যাঁ, সম্পর্কে এই বাড়ি তাঁর মামার বাড়ি। অদ্রিজা জানালেন, “আজও এই বাড়িতে সংরক্ষিত আছে ওঁদের আঁতুড়ঘর। কিছুদিন আগে ফলকও বসেছে এই ঘরে।”
চলতি বছরে ১০৪-এ পা রেখেছে ভট্টাচার্য বাড়ির পুজো। তবে দেখতে গেলে, এই পরিবারের দুর্গা আরাধনার চল আরও প্রাচীন। জানা গেল, অবিনাশ ভট্টাচার্যের বাবা উমাচরণ ভট্টাচার্য এবং তাঁর ভাই প্রসন্ন ভট্টাচার্যের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল এই পুজোর।
এই বাড়ির ইতিহাসের অনুসন্ধান যখন চলছে, তখনই সন্ধিপুজোর তোড়জোড় ঠাকুরদালানে। ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ। জানা গেল, এই বাড়িতে পুজো হয় এক বিশেষ পুঁথি মেনে। পারিবারিক এই পুঁথিতেই লেখা আছে পুজোর মন্ত্র, আচার কিংবা নিয়মাবলি। পুঁথি মেনেই, অষ্টমীতে দেবীকে ১০৮টি পদ্ম অর্পণ করে থাকেন ভট্টাচার্য বাড়ির সদস্যরা। এমনকি বাড়ির সদস্যরাই পৌরোহিত্য করেন এই পুজোয়। অদ্রিজার কথায়, “দুর্গাপুজো আমাদের কাছে অনেকটা রিইউনিয়নের মতো। পুজোর সময় আরও বেশি করে টের পাওয়া যায় পারিবারিক বন্ধনের বিষয়টা।” বলতে গেলে, পরিবারের সমস্ত সদস্যের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই যেন পুজোর আমেজ গড়ে তোলে এই পুজোর।
শুধু পুজোর চারটে দিনই নয়, ভট্টাচার্য বাড়ির এই উৎসবের আমেজ টের পাওয়া যায় প্রতিপদ থেকেই। বলতে গেলে এ-বাড়িতে পুজো শুরু হয়ে যায় সেদিন থেকেই। প্রতিপদে ঘটপুজোর পর, ষষ্ঠীতে বেলগাছে পুজো দিয়ে শুরু হয় দেবীর বোধন। জানা গেল, শুধু অষ্টমীই নয়, পুজোর প্রতিটা দিনই অঞ্জলি হয় এই বাড়িতে।
যে-কোনো বনেদি বাড়ির পুজো সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে বিশেষ বিশেষ রীতি-রেওয়াজ। ভট্টাচার্য বাড়িতেও অন্যথা নেই তার। মজার ছলেই অদ্রিজা জানালেন, “পুজোর এই কটা দিন অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমাতে যেতে হয় না। ঢাকের আওয়াজেই ঘুম ভাঙে আমাদের।” হ্যাঁ, ভোর সাড়ে চারটে থেকেই বাদ্যি বেজে ওঠে এই বাড়িতে। শুরু হয় পুজোর যোগাড়-যন্ত্র। দেবীর প্রসাদ অর্থাৎ ভোগের ক্ষেত্রেও রয়েছে অভিনবত্ব। নবমীতে চালকুমড়ো, শসা বলি হলেও দেবীকে দেওয়া হয় আমিষ ভোগ। আবার নবমীতে পাতে জায়গা করে নেয় বিশেষ পদ— অসুরের বড়া। “কলা দিয়েই তৈরি হয় এই বড়া। কিন্তু প্রচলিত আছে এই বড়া খেলে গায়ে অসুরের মতো জোর হয়”, হাসতে হাসতে জানালেন অদ্রিজা।
জানা গেল, আরও এক অদ্ভুত আচারের কথা। ‘সুবচনী পুজো’। অষ্টমীতে যেমন বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্যাকে কুমারী রূপে পুজো করা হয়, তেমনই ‘সুবচনী পুজো’ করা হয় বাড়ির নবদম্পতিদের মঙ্গলার্থে। অন্যদিকে বিসর্জনের সময়, আজও পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে ১৮ জন বেয়ারা কাঁধে করে দেবীকে নিয়ে যান ইছামতীতে। পথে দু’দিকে ছড়িয়ে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত বিকেলের শেষ সূর্যালোক খেলা করে তখন। তারপর নৌকায় চাপিয়ে মাঝ-নদীতে বিদায় জানানো হয় দেবীকে। সে-দৃশ্যও কি কম আকর্ষণীয়? “দেবীর সঙ্গে পায়ে হেঁটে আমরাও ঘাটে যাই সকলে। মনে হয়, ঘরের মেয়ে যেন চলে যাচ্ছেন। এটা একটা অন্য অনুভূতি”, বলতে বলতে ভারী হয়ে আসছিল অদ্রিজার গলা।
সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গেই ব্যস্ততা বেড়েছে মানুষের। ফলে, ধীরে ধীরে কম-বেশি লোকবল কমছে সমস্ত বনেদি বাড়িতেই। তবে আড়বালিয়ার ভট্টাচার্য বাড়ির ছবিটা একটু অন্যরকম। পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন বাড়ির তরুণ প্রজন্মের সদস্যরাই। ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সাবেকিয়ানা টিকিয়ে রাখতে বন্ধপরিকর তাঁরা সকলেই…
Powered by Froala Editor