রাজস্থানের উত্তরে সিকার জেলার একটি গ্রাম বাই। আজকের আধুনিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে সেই গ্রামের বাসিন্দারা ফিরে যান ইতিহাসের পাতায়। তখন ভারতের মাটি ছিল পরাধীন। অন্যান্য গ্রামের মতো এই বাই গ্রামও ব্রিটিশ অত্যাচারের সাক্ষী ছিল। আর তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদে নেমেছিলেন একজন। আজ সেই মানুষটার বয়স একশো পেরিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন এক সময়, একের পর এক পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছেন। রাজস্থানের ১০২ বছর বয়সী রামেশ্বর চৌধুরীর আজকে এসে কীরকম মনে হয়?
এই প্রশ্নটার সম্মুখীন হলেই মুখে গ্রাস করে কালো একটা ছায়া। এই কিছুক্ষণ আগে যে মানুষটার মুখে হাসি ছিল, এখন তিনিই স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। বর্তমান ভারতের অবস্থার কথা বললেই চলে যান স্মৃতির কাছে। ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে আসতে থাকে একের পর এক ঘটনা। কিন্তু কোনো কিছুর সঙ্গেই আজকের ভারতকে মেলাতে পারেন না এই বৃদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামী। ‘৩০স্টেডস’ নামক একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে রামেশ্বর চৌধুরী জানান, ‘এই ভারতের জন্য আমরা লড়াই করিনি… আমাদের সমস্ত কান্না, সমস্ত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার লড়াই করেছি।” আজকের ভারতকে সেই আদর্শের সঙ্গে যেন কিছুতেই মেলাতে পারেন না রামেশ্বরবাবু…
মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখদের দেখে স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রামেশ্বর চৌধুরী। গান্ধীজির হরিজন নীতি ও খাদির সাধারণ যাপন ও দর্শনই হয়ে উঠেছিল তাঁর পাথেয়। ব্রিটিশ শাসনের সময় রাজস্থানের গ্রামগুলোতে সাধারণ কৃষক, দরিদ্র মানুষ ও হরিজনদের ওপর অত্যন্ত অত্যাচার করা হত। শুধু ব্রিটিশরাই এমনটা করত তাই নয়, স্থানীয় জমিদার, মহাজনদের সঙ্গেও তাঁদের লড়তে হত। দিনরাত বেগার খাটানো হত; সেইসঙ্গে ছিল সরকারের অদ্ভুত সব কর ব্যবস্থা। রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বের হলেও আলাদা কর দিতে হত (ধুঁয়া লাগান), আবার মাটিতে বড়ো মাদুর পেতে বসলেও দিতে হত টাকা (বিছাই লাগান)। এর ওপর অন্যান্য কর তো রয়েছেই। না দিতে পারলেই অত্যাচার!
এসবের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করেছিলেন রামেশ্বর চৌধুরী। তিনি নিজে জমিদার পরিবারের সন্তান; কিন্তু নিজের বাড়িতে এমন অত্যাচারের পরিবেশ বা মনোভাব দেখেননি। বরং বাড়ির ভেতর থেকেই স্বদেশি মনোভাব তাঁর রক্তে ঢুকেছিল। যখন এগারো বছরের কিশোর, তখন থেকেই হরিজন ও গ্রামের গরীব মানুষদের জন্য লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি। কুড়ি বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে যোগ দেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। গান্ধীর আদর্শকেই বহন করে নিয়ে এসেছেন গোটা জীবন। বার্ধক্যে পৌঁছেও নিজের কাজ নিজে করার মন্ত্র থেকে সরেননি তিনি।
স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে দেশ। ১০২টি বসন্ত পেরিয়েছেন রামেশ্বর চৌধুরীও। কিন্তু দেশের এখনকার ছবি তাঁকে আতঙ্কিত করে, কোথাও কোনো মিল খুঁজে পান না। ‘সবাই যাতে সমান মর্যাদায় এই দেশে বসবাস করে সেটাই চেয়েছিলাম আমরা। ধর্ম, জাতি, বর্ণের ভিত্তিতে নয়, মানুষের পরিচয় হোক মানুষ হিসেবে। সেইভাবেই গড়ে উঠুক ভারত। আফসোস, এখন সেসব দেখতে পাই না।’ দুর্নীতি, ক্ষমতা আর টাকার খেলাই যেখানে মুখ্য উপাদান, সেখানে নৈতিকতা, শিক্ষার জায়গা কোথায়? এমন প্রশ্নই তুলেছেন তিনি। তাঁর এও বক্তব্য, স্বাধীনতা দিবস আর সাধারণতন্ত্র দিবস এলেই জীবিত বিপ্লবীদের কথা মনে পড়ে সরকারের। কত স্বাধীনতা সংগ্রামীর শেষ জীবনটা কেটেছে প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে। সরকারের তরফ থেকে কোনরকম সাহায্যই করা হয় না। এর জন্যই কি বলিদান দিয়েছিলেন বিপ্লবীরা? এমন ছবি দেখবেন বলে? শুধু রামেশ্বর চৌধুরী নন, এমন প্রশ্ন যে আরও অনেকের…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
‘জেল না-খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী’ গোষ্ঠ পাল; ব্রিটিশদের অন্যায়ের প্রতিবাদে ছেড়েছিলেন ফুটবলও