ভারতে প্রথম করোনার সংক্রমণ ধরার পরার পর পেরিয়ে গেল প্রায় ৬ মাস। ৩০ জানুয়ারি কেরালায় প্রথম মিলেছিল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। তার মাত্র ১৭০ দিনের মধ্যেই আজ সেই সংখ্যা ছুঁল ১০ লক্ষে। মৃত্যু হয়েছে এর মধ্যে ২৫ হাজার ৬০০ মানুষের। তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন নতুন নতুন রেকর্ড। বৃহস্পতিবার একদিনে আক্রান্ত হলে ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ। মৃত্যু হল প্রায় ৭০০ মানুষের। বাংলার অবস্থাও দিন দিন শোচনীয় হতে চলেছে। মৃত্যুর সংখ্যা ছুঁয়েছে হাজার। দৈনিক আক্রান্তের নয়া রেকর্ড ১৬০০-র বেশি।
গত মার্চ মাসে ভাইরাসের মোকাবিলা করতেই দেশব্যাপী লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু কতটা পরিকল্পনা ছিল তার পিছনে এখন উঠছে সেই প্রশ্নই? লকডাউন ঘোষণার কারণে হাজার হাজার শ্রমিক আটকে পড়েছিলেন ভিন রাজ্যে। ছিল না উপার্জনও। কাজেই বাড়ি ফেরার তাগিদ দেখা দিয়েছিল। তাতে আরোই বেড়েছিল সংক্রমণের আশঙ্কা। শেষ অবধি তাই সত্যিই হল। অন্যদিকে পরিকল্পনাহীন ভাবেই তুলে নেওয়া হল লকডাউন। তার পিছনে যুক্তি অবশ্যই রয়েছে। অর্থনৈতিক পতন আটকানো। কিন্তু সংক্রমণের যেভাবে বাড়ছে তাতে আক্রান্তের হার অন্যভাবেই আঘাত আনবে সেই অর্থনীতিকেই। আনলকের পর্বে হেঁটে আদৌ কি লাভ হল দেশের? যেমন লাভ হয়নি মার্চে ঘোষণা করা লকডাউনের।
ইতালি, জার্মানি কিংবা নিউজিল্যান্ডের মত দেশগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের সফলতার মূল কারণ হল নিশ্ছিদ্র পরিকাঠামো। লকডাউনে ভাইরাস উধাও হয়ে যায় না। তবে ক্রমাগত টেস্টিং, কন্ট্যাক্ট টেসিংয়ের মাধ্যমে তার পরিধিকে ছোটো করে আনা হয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থাও নাগরিকদের জন্য প্রদান করেছিল দেশগুলি।
পাশাপাশি ভারতে টেস্টের সংখ্যা প্রতি লক্ষ মানুষে মাত্র ৭০০-৭৫০। যা অন্যান্য দেশগুলিতে ১২ হাজারের কাছাকাছি। বারবার পরিসংখ্যান দিতে গিয়ে প্রশাসন বলছে ‘মৃত্যুর হার আমাদের দেশে অনেক কম’। এই মন্তব্য অনেকেটা বালিতে মুখ লুকিয়ে রাখা উটপাখির মতোই। যে ভাবে, তার পিছনে আর ধাওয়া করছে না শিকারি। সত্যিই কি মৃত্যুর সংখ্যা কম এখনও? মৃত্যুর নিরিখে ভারত এখন ৮ নম্বর স্থানে। ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে মৃত্যুর সংখ্যা। কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে দেখতে গেলে ভারতের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ-ও মানুষ নেই অন্যান্য উন্নত দেশগুলিতে। মৃত্যুর হার কম হলেও সংক্রমণ বাড়লে তা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, তা একবারও ভাবা হচ্ছে না। যেখানে টেস্টই এত স্বল্প পরিমাণে হচ্ছে, সেখানে কতজন মানুষ আসলে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হচ্ছেন তাই তো জানা যাচ্ছে না। স্পষ্টতই বাড়ছে কো-মর্বিডিটি।
ব্রিটিশ একটি ইউনিভার্সিটি জানিয়েছিল, জুলাইয়ের মধ্যে ৮ লক্ষ সংক্রমণ হবে ভারতে। তা তখন আষাঢ়ে গল্প লেগেছিল সকলেরই। অন্যদিকে আরেকটি গবেষণা সম্প্রতি জানিয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা দিনে ২ লক্ষ ৮৭ হাজার ছোঁবে ভারতে। এখনকার পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সেই অশনিসংকেতকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না মোটেই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামো কি এই বিপুল পরিমাণ রোগীকে জায়গা দিতে পারবে আদৌ? তখন হয়তো নীরবেই দেখতে হবে মৃত্যু মিছিল!
তবে শুধুই যে পরিকাঠামো, পরিকল্পনার অভাব তা নয়। অভাব রয়েছে সচেতনতার। আমরা নিজেরাই বা কতটা সচেতন নাগরিক হয়ে থাকতে পেরেছি লকডাউনে? শুরুর দিকে পুলিশের ভয়ে অনেকেই বন্দি ছিলেন বাড়িতে। ধীরে ধীরে যত শিথিল হয়েছে নিয়ম, ততই বেড়েছে লকডাউন-অমান্য করার স্বাদ। অধিকাংশ জায়গাতেই বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই সোশ্যাল ডিসট্যান্সের। অনেকের মুখে নেই মাস্কও। নিজেদের সতর্ক না হলে আদৌ কি ফলপ্রসূ হবে লকডাউন? যার কারণে পুনরায় এক সপ্তাহ বা দু’সপ্তাহের আপৎকালীন লকডাউনগুলিকেও ডাহা হার মানাচ্ছে মারণ ভাইরাস।
আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত জেলবন্দি কবি ভারভারা রাও, বাড়ছে দুশ্চিন্তা
এখন দেশের মানুষ প্রায় নিরুপায় হয়েই নির্ভর করে আছে ভ্যাকসিনের দিকে। শুরু হয়েছে আইসিএমআরের জরুরি পরিস্থিতিতে ট্রায়ালও। আদর্শ পরিস্থিতি ধরে নিয়ে যদি ভাবা যায় আগস্টেই হাতে এল এই ভ্যাকসিন, সেক্ষেত্রেও ১৩৮ কোটি মানুষের জন্য ভ্যাক্সিন সরবরাহ করাও সোনার পাথরবাটি। ততদিন আটকে রাখা যাবে তো দেশের পরিস্থিতিকে? জানা নেই...
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সেপ্টেম্বরের আগেই ভারতে করোনা-আক্রান্ত হবেন ৩৫ লক্ষ, বলছে গবেষণা